নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ। রাত পেরিয়ে তখনও ভোর আসেনি। নীলচে কুয়াশার আস্তরনে ঢেকে গিয়েছে বাঁকুড়া জেলার সেগুনসরা গ্রাম সংলগ্ন জঙ্গল ও প্রান্তর। শেষ ঘুমের আমেজ না কাটায় পাখিদের কিচিরমিচিরও তখন শুরু হয়নি। ঘুমন্ত ও স্তব্ধ সেই চরাচরে কুয়াশার চাদর ঠেলে বেরিয়ে আছে শুধু খেজুর গাছের কিছু মাথা। আধো অন্ধকারের মধ্যেই একটা খেজুর গাছের দিকে কিছু নড়াচড়া নজরে আসতেই এগিয়ে গেলাম। ঠিক তখনই প্রায় ২০ ফুট উচ্চতার একটি খেজুর গাছের উপর থেকে সরসর করে প্রায় গড়িয়ে নিচে নামলেন বছর চল্লিশের আসরফ আলি মোল্লা। নিচে দাঁড়িয়ে থাকা সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া ছেলের হাতে একটি রসের হাড়ি নামিয়ে দিয়েই অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আবার পাশের গাছের দিকে দৌড়লেন আসরফ।
“পরিশ্রমটা শুধু দেখুন। আপনি শুধু আমাদের পরিশ্রমটা দেখুন”। টানা প্রায় তিরিশটি গাছে উঠে ও নেমে রসের হাড়ি সংগ্রহ করার পর গলগল করে ঘামতে থাকা শরীরটা গামছা দিয়ে মুছতে মুছতে বললেন আসরফ আলি। দিনের প্রথম ব্রেকটা যখন নিলেন আসরফ, তখনও ঠান্ডা কুয়াশার চাদর ফাটিয়ে সোনালি রোদ উঁকি মারেনি।
আসরফ, তাঁর ষাটোর্ধ বাবা আর ১৪-১৫ বছরের ছেলে তাজিবুল। এই তিনজনের প্রোডাকশন ইউনিট। সেগুনসরা গ্রামের প্রান্তে গোলাপ ফার্ম শেষ হলেই ধুধু অনুর্বর ফাঁকা জমি। ওপারেই জঙ্গল। সেখানেই রাস্তার ধারে তাল ও খেজুর পাতার অস্থায়ী ছাউনিতে খেজুর গুড় তৈরি করেন এই তিন পুরুষ। এ বার ১৮০টি খেজুর গাছ ইজারা নিয়েছেন তাঁরা। এই সমস্ত গাছে চাঁছার কাজ, হাড়ি বাঁধা, রস সংগ্রহ করা, জাল দিয়ে গুড় বানানো থেকে টিনে ভর্তি করে পাইকারি বাজারে পৌঁছে দেওয়া, পুরোটাই করতে হয় এই তিনজনকে। প্রায় সারা দিনের ব্যস্ততা।

মাঠের কাছ শুরু হয়ে যায় ভোর চারটে থেকেই। সারা রাত গাছ থেকে রস বেরিয়ে এসে জমেছে হাঁড়িতে। আলো ফুটে তাপমাত্রা বাড়ার আগেই গাছ থেকে রসেরহাঁড়ি নামিয়ে নিয়ে এসে জালে বসিয়ে না দিলে রস খারাপ হয়ে যাবে। গুড়েও থেকে যাবে সেই গন্ধ। পুরোটাই পন্ডশ্রম। তাই আলো ফোটার আগেই ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে রসের হাঁড়ি পেড়ে নেওয়ার কাজ শুরু করে দেয় আসরফ। সেই রস কয়েক খেপে সাইকেলে করে চলে আসে অস্থায়ী ছাউনির পাশেই সদ্য বানানো চুল্লিতে। জঙ্গল থেকে নিয়ে আসা ইউক্যালিপটাসের পাতার জ্বালানিতে দাউদাউ করে জ্বলতে থাকা চুল্লীতে লোহার কড়াইতে ফুটতে থাকে রস। কিছুক্ষণের মধ্যেই কাঁচের মতো স্বচ্ছ খেজুর রসে লালচে রং ধরতে শুরু করে। গুড়ের গন্ধ রাস্তা পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ে পাশের গ্রামে। ভিড় জমাতে শুরু করে বাচ্চা কাচ্চার দল। দিনের আলো তখন চড়া হতে শুরু করেছে।

বাবাকে গুড় বানানোর কাজে কিছুটা জোগাড়যন্ত্র করে দিয়ে কোনও রকমে নাকেমুখে দুটো গুঁজেই আবার ছেলেকে নিয়ে মাঠের দিকে হাঁটা দেন আসরফ। গাছের যে অংশ থেকে রস বেরোয়, তা নিয়মিত পাতলা করে চেঁছে দিতে হয় বিকেলের আগেই। তারপর একটা বাঁশের নল গাছের চাঁছা অংশে ফুটো করে বসিয়ে দিতে হবে আলতো করে। এই নল দিয়েই বেরিয়ে আসবে রস। সেখানেই বেঁধে দিতে হবে রস সংগ্রহের হাঁড়ি। দিনের দ্বিতীয় দফায় আবার একের পর এক গাছে ওঠানামার খেলা শুরু হয় আসরফের। গামছা দিয়ে কোমরে বাঁধা বাঁশের ঝুড়ির মধ্যে সাজানো থাকে তাঁর যন্ত্রপাতি-অস্ত্রশস্ত্র।

গাছ পিছু মালিককে নির্দিষ্ট টাকা দিয়ে দিতে হয় সিজনের শুরুতেই। রসের কাজ বাদ দিলেও তিন মাসের অস্থায়ী ঘর বানানো, চুল্লি তৈরি, লোহার ট্রে, রসের হাঁড়ি, জঙ্গল থেকে জ্বালানি সংগ্রহ করে নিয়ে আসা, এসবের মাঝে পুঁজি বলতে শুধু নিজেদের শ্রম টুকুই। তার পর পাইকারি বাজারে যে দামে গুড় বিক্রি হয়, তাতে আসলে বিক্রি হয় সেই শ্রমটাই। গুড়ের ব্যবসায় লাভ বলে কোনও কিছুর অস্তিত্ব এই প্রোডাকশন ইউনিটে থাকে না। পুরো গুড়টাই খেয়ে যায় বড়বাজার।

লোহার ট্রেতে চিনির বস্তা ঢালতে ঢালতে গুড়ের এই অর্থনীতির ক্লাস নিলেন আসরফের বৃদ্ধ বাবা। পাইকারি বাজারে গুড় বিক্রি করতে গেলে ক্যানো চিনি মেশাতেই হবে, সেই অঙ্ক বুঝলাম খুব সহজেই। গজগজ করতে করতে গুড়ের বৃদ্ধ কারিগর তখনও বলে চলেছেন, ‘ভাল গুড় কি আমাদেরও বানাতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু দাম কে দেবে? সংক্রান্তির আগে জমিয়ে ঠান্ডা পড়লে গাছকে তিনদিন জিরেন দেওয়ার পর প্রথম দিনের রসটা থেকে যে গুড় তৈরি হয়, সেই জিরেন গুড় আপনারা খাননি। খাওয়ার লোকই নেই। আমরাও কদিন পর ছেড়ে দেব এই পেশা। আজকালকার ছেলেপুলে আর এই পরিশ্রম করতে পারবে না’। ছোট হয়ে আসা বেলার সূর্য তখন ঢলে পড়েছে জঙ্গলের দিকে। বাবা আর ছেলের জন্য রাতের খাবার বানাতে শুরু করে দিয়েছে তিন মাসের জন্য ঘর ছেড়ে গুড় বানাতে আসা আসরফ।

চলবে …
কৃতজ্ঞতা: বাঁকুড়া রোজেস
Naren Mitrar Rosh..